শেষপর্ব
ছাই রঙা একটা শাড়ি পরে ঋত্বিকা সমুদ্রের ঢেউয়ের তালের সাথে একটা গান গাইছে। খেয়াল করেনি কে যে নিঃশব্দে পেছনে এসে দাঁড়িয়েছে। গানের শেষ লাইনটা ছিল এমন,”ভালোবেসে সখী নিভৃতে যতনে আমার নামটা লিখ তোমার মনের মন্দিরে।
“লিখেছি এতদিন আর লিখবও চিরকাল।”
(চমকে উঠে) “অয়ন!”
“তুমি একা যে? কবে এলে এখানে?”
“গতকাল। তুমি?”
“আমিও। কাল রাতে চলে যাব।”
“আমি ঘুরতে এসেছি। ব্যস্ত জীবনে হাঁপিয়ে উঠেছিলাম।”
“কেমন আছ তুমি?”
“ভালোই আছি। তুমি?”
“ভালো। দাদা কেমন আছেন?”
“দাদা?”
“তোমার বর।”
“নেই। আমি তো বিয়ে করিনি।”
“মানে? কেন? করবে না?”
“না। তোমার খবর বল।”
“আরে সেসব পরে হবে। আগে বল তুমি বিয়ে করলে না কেন?”
“সময় নিতে বলেছিলে আমায়। সময় নিয়ে বুঝলাম যে যেহেতু আলাপ আমার প্রথম প্রেম তাই ওকে আমার মনে পড়ে। আর পড়বেও সারাজীবন। কিন্তু ভালো আমি তোমায় বেসেছি। আর ফিরতি ভালবাসা নিতে হলে আমি তোমার কাছ থেকে নেব নইলে না।”
“তুমি আমার জন্যে অপেক্ষা করে আছ?”
“না, না। ঠিক অপেক্ষা না। কোনো expectation নেই আমার। আমি শুধু আমার মতো করে ভালবেসে গেছি এই এক বছর; আর এখনো বাসি। আচ্ছা, একটা সত্যি কথা বলবে?”
“বলো।”
“যে কারণটা দেখিয়ে বিয়েটা ভেঙেছিলে সেটা সম্পূর্ণ মিথ্যে ছিল,তাই না?”
“আর কী করতাম বলো? বিয়েটা ভাঙতে হতো। কিন্তু কোনো কারণ খুঁজে পাচ্ছিলাম না। অগত্যা একটা মিথ্যে মেডিকেল রিপোর্ট তৈরি করালাম এক বন্ধুকে দিয়ে যে আমি বাবা হতে পারব না। ব্যস, কাজ হয়ে গেল। আমি আমার বাবা মাকেও মিথ্যে বলে রাখলাম যাতে অন্য মেয়েকে বিয়ে করতে না বলে।”
“অয়ন! তুমি আমাকে আজও এতো ভালবাসো?”
“আমি নিজেকে ভালবাসি ঋত্বিকা। আর নিজেকে ভালো রাখার জন্যে আমার তোমাকে ভালবাসা প্রয়োজন। Basic need-এর মতো।”
ঋত্বিকা হাসল। তার চোখের কোণে জল সমুদ্রের মিঠে রোদে ঝলমল করছে। পাশের আগাছা থেকে একটা ফুল তুলে নিল ঋত্বিকা। আর হাঁটু গেড়ে বসে বলল,”will you marry me?”
অয়ন মুখে কিছু বলল না। শুধু ঋত্বিকাকে উঠিয়ে বসাল তার পাশে। আর প্রচণ্ড উত্তেজনায় বলল,”আজ আমার পাগলামি করতে খুব ইচ্ছে করছে। করবে?”
“হ্যাঁ, বলো।”
“চলো পালিয়ে বিয়ে করি।”
“তার আগে একটা কবিতা বলবে দু’জনে?”
“ঠিক আছে।”
“চলো না শেষের কবিতার কিছু লাইন বলি?”
“কেন? হঠাৎ লাবণ্য হয়ে ওঠার ইচ্ছে?”
“জানি না। তবে খুব ইচ্ছে করছে।”
“আমি কিন্তু অমিত নই – শোভনলাল।”
সমুদ্রের হাওয়ার সুর আর গর্জন তাদের কবিতায় এক নতুন মাত্রা দিল। শুরু করল অয়নই।
“এই দেখুন-না, আজ সকালে বসে হঠাৎ খেয়াল গেল, আমার জানা সাহিত্যের ভিতর থেকে এমন একটা লাইন বের করি যেটা মনে হবে এইমাত্র স্বয়ং আমি লিখলুম, আর কোনো কবির লেখবার সাধ্যই ছিল না।”
“বের করতে পেরেছেন?”
“হ্যাঁ,পেরেছি।”
“লাইনটা কী বলুন-না।”
“For God’s sake, hold your tongue
and let me love!
দোহাই তোদের, একটুকু চুপ কর।
ভালোবাসিবারে দে আমারে আমারে অবসর।”
“সুখবর আছে। মাসিমার মত পেয়েছি। যদি আপত্তি না কর তোমার নামটা একটু ছেঁটে দেব।
তোমাকে ডাকব বন্য বলে।”
“বন্য!”
“না না, এ নামটাতে হয়তো-বা তোমার বদনাম হল। ওরকম নাম আমাকেই সাজে। তোমাকে ডাকব- বন্যা। কী বল?”
“তাই ডেকো, কিন্তু তোমার মাসিমার কাছে নয়।”
“কিছুতেই নয়। এ-সব নাম বীজমন্ত্রের মতো, কারো কাছে ফাঁস করতে নেই। এ রইল আমার মুখে আর তোমার কানে।”
“আচ্ছা বেশ।”
“আমারও ঐরকম একটা বেসরকারি নাম চাই তো। ভাবছি ‘ব্রহ্মপুত্র’ হলে কেমন হয়। হঠাৎ বন্যা এল তারই কূল ভাসিয়ে দিয়ে।”
“নামটা সর্বদা ডাকার পক্ষে ওজনে ভারী।”
“ঠিক বলেছ। কুলি ডাকতে হবে ডাকবার জন্যে। তুমিই তাহলে নামটা দাও। সেটা হবে তোমারই সৃষ্টি।”
“আচ্ছা, আমিও দেব তোমার নাম ছেঁটে। তোমাকে বলব মিতা।”
“চমৎকার! পদাবলীতে ওরই একটা দোসর আছে- বঁধু। বন্যা, মনে ভাবছি, ঐ নামে না হয় আমাকে সবার সামনেই ডাকলে, তাতে দোষ কী।”
“ভয় হয়, এক কানের ধন পাঁচ কানে পাছে সস্তা হয়ে যায়।”
“সে কথা মিছে নয়। দুইয়ের কানে যেটা এক, পাঁচের কানে সেটা ভগ্নাংশ। বন্যা!”
“কী মিতা।”
“তোমার নামে যদি কবিতা লিখি তো কোন মিলটা লাগাব জানো?-অনন্যা।”
“তাতে কী বোঝাবে?”
“বোঝাবে তুমি যা তুমি তাই-ই, তুমি আর কিছুই নও।”
“সেটা বিশেষ আশ্বর্যের কথা নয়।”
“বল কী, খুবই আশ্বর্যের কথা। দৈবাৎ এক-একজন মানুষকে দেখতে পাওয়া যায় যাকে দেখেই চমকে বলে উঠে, এ মানুষটি একেবারে নিজের মতো, পাঁচজনের মতো নয়। সেই কথাটি আমি কবিতায় বলব-
হে মোর বন্যা, তুমি অনন্যা,
আপন স্বরূপে আপনি ধন্যা।”
“তোমারে যা দিয়েছিনু সে তোমারি দান-
গ্রহণ করেছ যত ঋণী তত করেছ আমায়।
হে বন্ধু, বিদায়।”
গোধূলির শুভলগ্নকে সাক্ষী রেখে পথ চলতে শুরু করল অয়ন ও ঋত্বিকা; আবার নতুন করে।