পর্ব- ১
এই এতক্ষণ পর একটু স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলতে পারলেন বিনয়বাবু। পুরনো বাসা ছেড়ে নতুন একটা বাসা ভাড়া করেছেন তিনি। বাসাটা খুবই ছোট। তবে একলা মানুষের পক্ষে যথেষ্ট। চারতলা বাড়ির দোতলায় থাকেন তিনি। স্ত্রী বিয়োগের পর একাকীত্বই যেন আগলে রাখছে তাকে।আগের বাসায় সর্বত্র অভয়ার স্মৃতি ছড়িয়ে। খেতে-ঘুমোতে উঠতে-বসতে শুধু অভয়ার অভিনীত চলচ্চিত্র দেখতে পান তিনি ঘরের আনাচে কানাচে। তাই ঐ বাসায় একা থাকা রীতিমতো মানসিক চাপের হয়ে যাচ্ছিল দিন দিন। বিনয়বাবুর সন্তানাদি নেই। তিনি একজন প্রৌঢ়। অভয়া দেবী চলে যাওয়ার পর তিনি এতটাই একাকিত্ব বোধ করেন যে বাকি জীবনটা কী নিয়ে কাটাবেন তাই তার সারাদিনের একমাত্র চিন্তা। এমন সময় অত বড় বাসায় থাকাটা শ্বাসরুদ্ধকর। তাই তার বাসা পাল্টানোর এই প্রয়োজনের উপস্থিতি।
ওহ হ্যাঁ! বিনয়বাবুর সাথে আরও একজন থাকে। নাম তার হরি। বিনয়বাবুর যাবতীয় দেখাশুনো এখন এই ব্যক্তিই করে। হরি প্রায় আট বছর ধরে বিনয়বাবুর কাছে থাকে। বাসা পাল্টানোর প্রস্তাব সেই প্রথম বিনয়বাবুকে দেয়। অভয়া মারা যাবার পর থেকে তার না কি ও বাড়িতে থাকতে ভয় করে। অগত্যা বিনয়বাবুকে হরির কথা রাখতে হল। কারণ বিনয়বাবুর এ পৃথিবীতে হরি ছাড়া আর কেউ নেই। আর হরিকে তিনি নিজের ভাইয়ের মতোই স্নেহ করেন।
ঘরে আসবাবপত্র বলতে তেমন কিছুই নেই। ঐ সামান্য আসবাব গুছিয়ে দুপুরে খেয়ে একটু গড়িয়ে নিতে গেলেন বিনয়বাবু। ঘুম থেকে উঠে দেখেন হরি পাশে বসে আছে।
“বাবু চা খাবেন?”
“হ্যাঁ রে। দে।”
হরি চা বানিয়ে নিয়ে এলো। সাথে দু’টো বিস্কিট। হরির সাথে গল্প করতে করতে বিকেল গড়িয়ে গেল। দক্ষিণমুখী জানলা দিয়ে গলির বাইরের রাস্তাটা দেখছিলেন বিনয়বাবু। কত গাড়ি, কত মানুষ, কত রং, কত ছবি। একেকজনের জীবন এক এক রকম; আলাদা আলাদা গল্প। এক আইসক্রিমওয়ালা চলে গেল তার আইসক্রিমের ভ্যান নিয়ে। বিনয়বাবুর ছোটবেলার কথা মনে পড়তে লাগল।
“দাদা, একটা আইসক্রিম কিনে দিবি রে? দে না রে।”
“টাকা কোথায় পাব রে? আইসক্রিমের টাকা তো নেই সাথে।”
“বাবা যে টাকা দিল?”
“ওতো চিনি কিনতে দিয়েছেন।”
“দে না দাদা।”
সেদিন কম চিনি কিনে বাড়ি ফিরেছিল কিশোর বিনয়। তারপর বাবার সে কী বকুনি! বোনকে বাঁচাতে মিথ্যে বলেছিল সে। বলেছিল, বাকি টাকা না কি হারিয়ে গেছিল; তাই কম চিনি কিনতে হয়েছে তাকে। তবে আইসক্রিমটা খুব তৃপ্তি করে খেয়েছিল তার বোন। বোনের সেই মিষ্টি হাসিমাখা মুখটা আজও মনে পড়ে তার।
গলির স্ট্রিট লাইটটার নিচে একটা কিশোর ছেলে এসে দাঁড়িয়ে আছে অনেকক্ষণ ধরে। প্রথমটায় তিনি খেয়াল করেননি। এবার খেয়াল করলেন। রাস্তার ওপার থেকে এক কিশোরী তার খোলা চুল হাওয়ায় মেলে ছেলেটির দিকেই আসছে। মেয়েটা কাছে আসতেই দু’জনের মুখে হাসির ঝিলিক খেলে গেল। শত ক্রোশ হাঁটার পর যেন দিগন্ত খুঁজে পেয়েছে ওরা। পুরোটা সময় বিনয়বাবু ওদের দেখতে লাগলেন। কিন্তু বেশিক্ষণ না। একটু পরেই মেয়েটা চলে গেল-আর ছেলেটাও। পরদিন ওরা এল না। বিনয়বাবু সারা বিকেল ওদের জন্যে অপেক্ষা করলেন। নাহ্! এল না। তার মনে হল আর বুঝি আসবে না ওরা। কেন জানি ওদের দেখে ভালো লেগে গেছে বিনয়বাবুর। মনে পড়ে যায় অভয়ার সাথে রঙিন দিনের কথা। পারিবারিকভাবে বিয়ে হয়েছিল বিনয়বাবু আর অভয়ার। প্রথমটায় কেউই কাউকে চিনত না। কিন্তু বন্ধুত্ব হয়ে যাওয়ার পর একে অপরকে নিয়ে ভাবতো। অফিসের কাজের ফাঁকে মনে পড়তো অভয়ার কথা। অভয়া একটা নিয়ম করে দিয়েছিল। প্রতি সপ্তাহে একে অপরের প্রতি যত অভিযোগ, খারাপ লাগা, ভাল লাগা, প্রাপ্তি-অপ্রাপ্তি আর চাহিদা যা আছে তা একটা কাগজে চিঠির মত লিখে টেবিলে রেখে যেতে হবে। দিনটা ছিল বুধবার। একদিনও মিস্ হলে চলবে না। এতে না কি একে অন্যকে চেনাটা সহজ হবে। ভাবতে ভাবতে বিনয়বাবুর ঠোঁটের কোণে একটু হাসির রেখা ফুটে ওঠে। আর মনে মনে বলেন,”অভয়া, আমায় বুঝি তোমার চেনা হয়ে গেছে? তাই চলে গেলে একলা রেখে?”